রিগান ভূইয়াঁ: কালের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন । সেখানে স্থান করে নিচ্ছে প্রযুক্তির কৃত্রিমতা। তেমনি কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলার বিনোদনের এই লোকজ মাধ্যমটি। টিভি, ভিসিডি আর আকাশ সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারণে আপনা আপনিই উঠে গেছে বায়োস্কোপের চল্ । যা এক সময় ছিল গ্রাম বাংলার শিশুদের চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। ভেঁপু বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে আহবান জানিয়ে দুলদুল ঘোড়া, মক্কা-মদিনা, আজমির শরীফ ও ক্ষুদিরামের ফাঁসির বায়োস্কোপ দেখিয়ে শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষকে সমান তালে আনন্দ দিত।
বায়োস্কোপকে এক সময় বলা হতো গ্রাম বাংলার সিনেমা হল। যেকোনো মেলা, উৎসব পার্বণে দেখা মিলতো এর। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অচেনা এই যন্ত্র। আকাশ সংস্কৃতির দাপট আর ইন্টারনেটের যুগে এখন কোণঠাসা বায়োস্কোপ।
বায়োস্কোপ একটি বাক্স, যার বাইরে দিয়ে একাধিক খুপড়ি বা একটি জানালার মতো জায়গা, যেখানে চোখ লাগিয়ে দেখতে হয়। চোখ মেললেই বাক্সের ভিতর দেখা যায়- দূরের দিল্লি শহর, রাম-লক্ষণের যুদ্ধ, আফগানের যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ অনেক ঘটনাবহুল রঙিন ছবি, যা দর্শকপ্রাণে শিহরণ জাগায়, অন্য রকম অনুভূতির সঞ্চার করে। বিশেষ করে শিশুদের চিত্ত বিনোদনের আধুনিক মাধ্যম ছিল এটি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯৮ সালে বঙ্গদেশে প্রথম বায়োস্কোপ দেখান হীরা লাল সেন নামে এক বাঙালি। পরবর্তীতে যিনি নির্মাণ করেন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র।
তখন গ্রামে নানা ধরনের মেলা বসত। মেলায় নানা রকম খাবার-দাবার, মাটির, বাঁশের এবং অন্যান্য নানান ধরনের জিনিসপত্রের দোকান থাকত। আর মেলার সবচেয়ে আকষর্ণীয় বিনোদন ছিল, নানা রকমের খেলা। যেমন ষাঁড়ের দৌড়, ঘোড়ার দৌড়, লাঠিখেলা, সাপখেলা, বানরখেলা, গাঙ্গিখেলা, পুতুল নাচনাগরদোলা ইত্যাদি। অপরদিকে মেলার এক কোণায় বায়োস্কোপওয়ালা তার চিরাচরিত আওয়াজ দিয়ে দর্শকদের ডাকছেন, ছড়া-ছন্দে বলছেন আকর্ষণীয় বাক্য আর দেখিয়ে যাচ্ছেন বাক্সের ভিতরের রঙিন ছবি। খঞ্জনি আর গানের তালে তালে বাক্সের ভেতরেও পাল্টে যায় ছবি। আর তা দেখে যেন গল্পের জগতে হারিয়ে যায় ছেলে বুড়ো সবাই। একজনের পর একজন; এক পয়সা, দুই পয়সা কিংবা তিন পয়সা দিয়ে দেখছে। ঘাড় নিচু করে, কোমার বাঁকিয়ে, দুই চোখের দুই পাশে দুই হাত রেখে কয়েক মিনিট ধরে একটানা দেখছে দিল্লি, ঢাকা, মুজিব, মক্কা-মদীনা আর কান দিয়ে
শুনছে বায়োস্কোপওয়ালার ছান্দসিক বাক্য-এই দ্যাখেন ভাই ঢাকা শহর, এই দ্যাখেন ভাই দিল্লি ইত্যাদি।
এই যে দেখা, এইটার মজাই আলাদা! গ্রামীণ বাংলার বিনোদনহীন জীবনে বায়োস্কোপ নানা বয়সের মানুষকে আনন্দ দিতো, আলোড়িত করতো সেই সময়। তবে গ্রামেই শুধু নয়, নগর জীবনেও বায়োস্কোপ দেখা যেত। আধুনিক ঢাকার যারা গোড়াপত্তন করেন, সেই নওয়াবদের বাড়িতেও বায়োস্কোপ দেখানো হতো। তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বায়োস্কোপের রূপছায়াময় বিবরণ পাওয়া যায়।
বায়োস্কোপ গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রাণের মাধ্যম। সুতরাং বায়োস্কোপকে এ অঞ্চলের মানুষদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। গ্রামীণ প্রবীণ ব্যক্তিদের তো নয়ই।
নতুন প্রজন্মের মানুষেরদের কাছে বিশেষ করে যারা শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী জীবনযাপন করে অভ্যস্ত তাদের কাছে হয়তো হাস্যকর এক বোকা বাক্স মনে হবে। কিন্তু বায়োস্কোপ মোটেও হাস্যকর কোনো বস্তু ছিল না কিংবা ছিল না কোনো বোকা বাক্স! প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপ গ্রামবাংলার সিনেমা হল। রং-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচিত প্রলাপ বলতে বলতে ছুটে চলত গ্রামের স্কুল কিংবা সরু রাস্তা ধরে।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পেছন পেছন দৌড়াত গ্রামের ছেলেমেয়েরা। বায়োস্কোপওয়ালার এমন ছন্দময় ধারা বর্ণনায় আকর্ষিত হয়ে ঘর ছেড়ে গ্রামের নারী-পুরুষ ছুটে আসত বায়োস্কোপের কাছে। একসাথে সবাই ভিড় জমালেও তিন কী চারজনের বেশি দেখতে পারত না। সিনেমা হলের মতো এক শো, এরপর আবার আরো তিন বা চারজন নিয়ে শুরু হতো বায়োস্কোপ। আর এই বায়োস্কোপ দেখানোর বিনিময়ে দুই মুঠো চাল কিংবা দুই টাকা নিয়েই মহাখুশি হয়ে ফিরে যেত বায়োস্কোপওয়ালা।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম হিসেবে আমরা কি বাংলার ঐতিহ্যগুলোকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারি না? হয়তো পারি না। কিন্তু আজও, আমাদের বাবা-মা এই বয়সে এসেও টের পান তাঁদের বুকের গভীরে কোথায় যেন অমলিন রয়ে গেছে সেই রঙিন ছবিগুলো। টুকরো টুকরো অনেক ছবি ভেসে ওঠে তাঁদের চোখে। একসাথে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের জটলা। উৎসুক হয়ে বসে আছে তারা। চারটি আয়নায় চোখ লাগিয়ে শিশু-বুড়ো সব বয়সী মানুষ ছবি দেখার দৃশ্য উপভোগ করছে। সঙ্গে সেই চিরচেনা আওয়াজ- কি চমৎকার দেখা গেল।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের বিনোদনের এই লোকজ মাধ্যম। তবুও কোথাও না কোথাও দুএকজন রয়ে গেছে। সেই দুএকজন অকেজো হিসেবে ছুড়ে দেননি বায়োস্কোপকে। জড়িয়ে ধরে রেখেছেন নিজের সন্তানের মতো।মানুষ আজ বায়োস্কোপ না দেখলেও যখনই বায়োস্কোপওয়ালাদের মন চায় তখনই হয়ত তিনি গ্রামের সরু রাস্তা ধরে বায়োস্কোপ নিয়ে ছুটে চলেন। তিনি জানেন এখন আর কেউ টাকা দিয়ে দেখবে না, তারপরও তিনি বায়োস্কোপ নিয়ে বের হন। আবার দুএকজন আছেন যারা নির্দিষ্ট মৌসুম ছাড়া বায়োস্কোপ দেখান না। পেশা বদল করে প্রায় সবাই অন্য পেশা গ্রহণ করেছেন।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের একটু সুদৃষ্টি হয়ত বাচাঁতে পারে আমাদের হারিয়ে যেতে বসা এই ইতিহাস ও লোকজ ঐতিহ্যকে ।
নিউজনাউ/এমএএন/২০২১