পার্থ প্রতীম নন্দী, চট্টগ্রাম ব্যুরো: যাচ্ছে বছরে সারাবিশ্বের মতোই বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও সবচেয়ে বহুল লিখিত ও উচ্চারিত শব্দ হলো করোনা। মহামারি করোনা পাল্টে দিয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানীর প্রায় সব হিসেব নিকেশ। করোনাকালেও চট্টগ্রামে ২০২০ সাল জুড়ে আলোচনায় ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন। কোভিডের বিষ ভুলে স্বজন হারানো বিশ সালকে বিদায় দিয়ে একুশ সালের অপেক্ষায় চট্টগ্রামবাসী।
চসিক নির্বাচন থেকে শুরু করে করোনার নির্বাসন; বছরজুড়ে চট্টগ্রাম মেতে ছিলো নানামুখি আলোচনায়। বর্ষপরিক্রমায় করোনার পাশাপাশি রাজনৈতিক উত্তাপও ছিলো সমান্তরাল এই নগরীতে। সাধে কি আর নাম তার ‘বীর চট্টলা’?
২০২০ সালের বছরের শুরুতেই চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল চসিক নির্বাচন। কে হবেন বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিএনপির মেয়র প্রার্থী- সেই নিয়েই ছিল জল্পনা কল্পনা। সব উত্তেজনায় জল দিয়ে ‘আউট অব বক্স’ একজনকে মেয়র প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। তিনি নগর আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী। আর বিএনপি বেঁচে নেয় তাদের নগর আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনকে।
২৯ মার্চ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হলেও মহামারি করোনা তাতে বাঁধসাধে। নির্বাচন উৎসবের নগরী থেকে এই শহর পরিণত হয় করোনা আতংকে। এই সময় চট্টগ্রামের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর বেসরকারি হাসপাতালের চরম অসহযোগিতায় নগর জুড়ে শুরু হয় হা-পিত্যেশ। বিনা চিকিৎসায়, আইসিইউ না পেয়ে স্বজন হারিয়েছেন অনেকেই।
তবে বীরচট্টলা যে নগরীর উপাধি তার কি পরজয় আর মাথা নত করা সাজে! কোভিডের ভয়াল থাবার চরম সংকটের বিপরীতে চট্টগ্রামবাসী দেখেছে মানবিক শত হাজার মানুষদের। সুগঠিত বাহিনীর হিসেবে এই মানবতায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। করোনার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তারা হারিয়েছেন ১০ জন সহকর্মী।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সরাসরি প্রায় সবাই। তবে যাদের লড়াইয়ের ফলে আমরা অনেকেই এখনো বেঁচে আছি তারা হলেন করোনা যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনার খ্যাত ডাক্তার-নার্সরা। সরাসরি দিনরাত এক করে তারা লড়েছেন হাসপাতালে। নিরন্তর সাহস দিয়েছেন এই নগরবাসীকে। এই লড়াই করতে গিয়েই তারাও হারিয়েছেন ১৩ জন চিকিৎসক সহকর্মী। এই সময়ে নাভানা গ্রুপের দেওয়া জায়গায় দেশের প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করেছেন ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তার আহবানে এই হাসপাতাল তৈরিতে নগরবাসীর অংশগ্রহণ ছিল এই বছরের অন্যতম পাওয়া। এরপর সারা চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে আরো অনেক করোনা নিরাময় সেন্টার। সেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ সালের সাহসী তরুণরা।
করোনার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর ছিল তালগাছের মতো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে। সারা বাংলাদেশের লাইফ লাইন খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ ছিলো না একদিনের জন্যেও। এই যুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরও হারিয়েছে তাদের অনেক সহকর্মীদের। এর বাইরে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ ছিল বছর জুড়ে আলোচনায়। পেঁয়াজ সহ দ্রব্যমূল্যে দাম বাড়া কমায় বারবার আলোচনায় এসেছে ব্যবসায়ীদের এই তীর্থক্ষেত্র!
করোনার শুরুতে চট্টগ্রামবাসীকে সাংবাদিকরা কথা দিয়েছিল, ‘আপনারা ঘরে থাকুন, খবর আমরা জানাবো’। সেই কথা রাখতে গিয়ে করোনা ভয় দূরে ঠেলে সাংবাদিকরা ছুটেছেন খবরের সন্ধানে। চট্টগ্রামে কমবেশি সকল সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকরা আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। তারপরও জনগণকে সঠিক তথ্য তুলে ধরে দুশ্চিন্তাহীন রাখার রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল সমাজের দর্পণ খ্যাত এই পেশার কর্মীদের।
করোনায় যে চসিক নির্বাচন পিছিয়ে গিয়েছিল তাতে নগরবাসী ছয়মাসের জন্য পেয়েছে স্মরণকালের অন্যতম একজন সেরা নগর সেবককে। দিনরাত এক করে সারা নগর তিনি চষে বেড়িয়েছেন। তিনি নিজেই নিউজনাউকে বলেছিলেন, ‘আমি করোনার ফাঁদে পড়ে প্রশাসক হয়েছি, নগরবাসীকে আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যাবো।’ বীর চট্টলার অন্যতম অভিবাবক এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এই প্রশাসক চলেছেন তার নেতার দেখানো পথেই। তিনি আর কেউ নন, নগর আওয়ামী লীগের আরেক পরীক্ষিত নেতা খোরশেদ আলম সুজন।
এছাড়াও চট্টগ্রামবাসীকে করোনামুক্ত রাখতে দিনরাত ছুটেছেন প্রায় সব দলের নেতাকর্মীরা। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি থেকে শুরু করে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে আবার ফিরে এসেছেন রাজনীতির মাঠে। এর মধ্যে ভাস্কর্য ইস্যুতেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক আসে এই চট্টগ্রাম থেকেই। মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের হুংকারের মাথা নত করে সেই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী।
করোনার মধ্যেও যে বিষয়টা চট্টগ্রামবাসীর জন্য এই বছরে আতংকের ছিল সেটা হল ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড আর কিশোর গ্যাং এর উৎপাত। ৯ মাসের করোনা স্থবিরতা মধ্যেও এ বছর শুধু চট্টগ্রাম নগরীতেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮১টি। থানাগুলোতে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের হয়েছে ৭৯৭টি। নতুন বছরে জনবান্ধব পুলিশিং এর জন্য এর মধ্যেই বাপক কাজ শুরু করেছে সিএমপি।
করোনায় চট্টগ্রামবাসীর পিঠ দেয়ালে ঠেকলেও সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। সারা বিশ্ববাসীর মতো চট্টগ্রামবাসীরও চাওয়া এমন অভিশপ্ত বছর যেন আর না আসে।
করোনা ভীতি দূর করে আবারও এই শহর প্রাণোচ্ছল হবে সেই প্রত্যাশায় ২০২১ সালকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় বীর চট্টলবাসী।
নিউজনাউ/এসএইচ/২০২০