শাহরিনা হক আদর: অর্জন-বর্জন-সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েই চলে যায় একেকটি বছর, আবার হাজারো সম্ভাবনা নিয়ে আসে নতুন আরেকটি বছর। কিন্তু চলে যাওয়া ২০২০ সালটি একদমই সুখকর ছিল না আমাদের জন্য। কারণ একটাই- করোনাভাইরাস। কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য প্রাণ, সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও বিপর্যস্ত। স্বজন আর জীবিকা হারিয়েছে অনেকে, ঝিমিয়ে পড়েছে অর্থনীতি। অসংখ্য দুর্দশার মধ্যেও দেশবাসীর সবচেয়ে বড় অর্জনের প্রশ্ন উঠলে সবাই সমস্বরে প্রথমেই নিশ্চয়ই ‘পদ্মাসেতু’র নামটিই বলবে। হ্যাঁ, স্বপ্নের পদ্মাসেতু। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ২২ টি জেলার প্রায় ৭ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ।
গেলো ১০ ডিসেম্বর পদ্মাসেতুর ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে ৬ হাজার ১৫০ মিটার পদ্মাসেতু। তৈরি হয়েছে দুই পাড়ের মানুষের সেতুবন্ধন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নিজস্ব অর্থায়নে বিজয়ের মাসে বাঙালি জাতির আরেকটি ঐতিহাসিক বিজয়।
পদ্মাসেতুর সার্বিক নির্মাণ কাজ চলছে এখনো। সেতু নির্মাণের সব কাজ তদারকি করছে সেনাবাহিনী। সরকারের পরিকল্পনামাফিক আগামী ২০২২ সালের শুরুতেই যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়ে আছে। এই সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে এই সেতুর মাধ্যমে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়ননশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হচ্ছে ইতিহাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে রয়েছে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর আববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতু। এটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর।
প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যান্য দাতাও সেটি অনুসরণ করে। পবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় ও সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এমন কোনও অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়।
বর্তমানে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এইকম’র ডিজাইনে পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার এসে সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছিল সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর ব্যয় আরও ১৪শ’ কোটি টাকা বাড়ে। ফলে পরবর্তীতে সেতুর মোট ব্যায় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
জেনে নেবো খুটিনাটি
পদ্মা সেতুর প্রকল্পের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’। ধরন দ্বিতলবিশিষ্ট। এই সেতু কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে, যা বিশ্বে প্রথম। ২০১৭-১৮ অর্থবছর পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ছিল ৫২৪ কোটি টাকা। নদীশাসন ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। পদ্মা সেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা। রেললাইন স্থাপন হচ্ছে স্প্যানের মধ্য দিয়ে। প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার। পদ্মাসেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার। সেতু প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পাড়ে ১২ কিলোমিটার।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ। সেতুর ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা রয়েছে ৬০ ফুট। পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট। পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং হয়েছে ৬টি। তবে মাটি জটিলতার কারণে ২২টি পিলারের পাইলিং হয়েছে ৭টি করে। মোট পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৮৬টি। নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ শেষ হলে দেশের মোট জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
নিউজনাউ/এসএইচ/২০২০