হাটহাজারী প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আহমেদ হোসেন (৭৩) নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন, বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত লোকমান হাকিমকে আটক করতে না পারলেও তার স্ত্রী নাহিদা সুলতানা (৪০)-কে আটক করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন সবুজ আটকের বিষয়টি নিউজনাউকে নিশ্চিত করেন।
এর আগে গত ১৫ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেনকে নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেন নিউজনাউকে বলেন, আমি একজন অসহায় মানুষ। বয়স হয়ে গেছে, শরীরে জোর পাই না। অর্থের অভাবে ভাঙ্গা ঘরটিও মেরামত করতে পারছিনা। কিছুদিন আগে ইউএনও স্যার, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহোদয় আমার বাড়িতে আসছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে (বীরনিবাস) বাড়ি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে আমার প্রতিবেশী লোকমান হাকিম আমার বাড়িভিটা দখলে নিয়ে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করে। আমি বাধা দিলে আমাকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করে। ঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি প্রথমে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারকে জানিয়েছি। তারা আমাকে ইউএনও স্যারের কাছে যেতে পরামর্শ দেন। উপজেলায় গেলে ইউএনও স্যার থানায় পাঠিয়ে দেন। থানায় অপেক্ষা করতে করতে ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. সেলিম জাহাঙ্গীর বিচার-মিমাংসা করবে বলে সময় নেয়। এই সুযোগে প্রতিবেশী লোকমান হাকিম ও তার ছেলেরা বাহির থেকে দলবল এনে আমাকে হামলা করে। বাড়ি ভাঙচুর ও জোরপূর্বক ভিটাতে বাউন্ডারি ওয়াল তোলে দেন। পরে ঘটনাটি ফেইসবুকে প্রচার হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন বলে জানান তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জায়গা সম্পত্তি বিরোধের জেরে চেয়ারম্যানের অনুসারীরা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রতিবেশী লোকমান হাকিমের সাথে মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেনের দীর্ঘদিন ধরে জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ চলছিল। অভিযুক্ত লোকমানের বড় ছেলে মো. ইমরাজ সাকিম বাবু (২৬) ও ছোট ছেলে মো. মিসপাত হাকিম তামিম (১৬), চেয়ারম্যান অনুসারী আদর, সজিব, নওশাদ, আশরাফ, মুন্না, তারেক, আরমানসহ আরো দশ পনেরজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেনকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করে।
শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেনের স্ত্রী, মেয়েদেরকে মারধরও করে তারা। বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। জোরপূর্বক বাড়িভিটাতে বাউন্ডারি ওয়াল তুলে দেয়। ৯৯৯-এ কল করলে পুলিশ এসে প্রথমে তাদের সরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর লোকমান হাকিম আবার এসে বলে, পুলিশ তাকে দেয়াল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্যকে জানালে তিনি গ্রাম চৌকিদার পাঠিয়ে নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধাকে ইউএনও’র কাছে যেতে পরামর্শ দেন।
তবে, ফরহাদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলম শওকত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশের সাথে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও তিনি এ ব্যাপারে কোন ধরণের মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঘটনায় জড়িতরা তার অনুসারী নন বলেও জানান তিনি।
এদিকে, গত ১৫ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় এ ঘটনা ঘটলেও দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এতদিন বিচার পাননি ওই মুক্তিযোদ্ধা। বিচারের আশা দেখিয়ে শুধুই ঘুরিয়েছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার। গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে হাটহাজারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের সভাপতি মোহাম্মদ হারুন উর রশিদ তার ফেসবুক আইডিতে মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের বিচার চেয়ে পোস্ট দেন। আর সেই পোস্ট ছড়িয়ে পড়লে ফুঁসে ওঠে এলাকাবাসী। আর তখনই টনক নড়ে প্রশাসনের। ওইদিন রাতে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,থানা পুলিশ, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
হাটহাজারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. নুরুল আলম নিউজনাউকে বলেন, আমরা ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি কোন দুষ্কৃতকারীর হামলার শিকার হওয়ার জন্য নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেন একজন সহজ সরল, নিরিহ মানুষ। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন মানে পুরো জাতিকে বেঁধে নির্যাতনের সামিল। ঘটনাটি শুনে আমি হতাশ হয়েছি। ইউএনও স্যারের সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলা, ভাঙচুর ও নির্যাতনের সত্যতা প্রমাণ পেয়েছি। অভিযুক্ত একজনকে আটক করা হয়েছে। প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
হাটহাজারী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন সবুজ নিউজনাউকে বলেন, জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেনকে প্রতিবেশীরা নির্যাতন করে। ঘটনার খবর পেয়ে থানা পুলিশ অভিযুক্ত লোকমান হাকিমের স্ত্রী নাহিদা সুলতানা (৪০)-কে আটক করেছে। এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিদুল আলম নিউজনাউকে বলেন, ‘ফরহাদাবাদ ইউপি এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি। ঘটনাটি খুব দুঃখজনক। এ নিয়ে আমরা মর্মাহত। আমার সাথে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহোদয় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেনকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন, ওনার ঘরে হামলা, ভাঙচুর ও বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে অবৈধভাবে জায়গা দখলের সত্যতা পেয়েছি। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত একজনকে আটক করা হয়।’
ইউএনও শাহিদুল আরো বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধাকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন, এটা সোজা কথা নয়। এটা সালিস-মিমাংসার বিষয় নয়। সোজা মামলা হবে। ঘটনার মূল হোতা লোকমান হাকিম (৪৫) ও তার ছেলেরা পালিয়েছে। বড় ছেলে মো. ইমরাজ সাকিম বাবু’র (২৬) পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন এবং ছোট ছেলে মো. মিসপাত হাকিম তামিম (১৬)’র জন্মনিবন্ধন জব্দ করা হয়। অবৈধভাবে গড়ে তোলা বাউন্ডারি ওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ওই অসহায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাননীয় সরকারের পক্ষ থেকে (বীরনিবাস) বাড়ি করে দেওয়া হবে।’
নিউজনাউ/আরএইচআর/২০২৩