এম নজরুল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ, যাঁকে তাঁর জীবনের প্রতি পরতে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। তিনি সেই মানুষ, যাঁর দুই চোখে সব সময় খেলা করেছে বাংলাদেশ। এক সুন্দর, সচ্ছল ও উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির চিন্তায় ব্যয় করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তির পর লন্ডনে দেওয়া বিবৃতি ও দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে দেওয়া বক্তব্যে তিনি দেশের মানুষকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রাখা, এর পর বিভিন্ন স্থানে বক্তব্যে তিনি শুধু দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলেছেন। সেই মহত্প্রাণ মানুষটি শুধু মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন। তিনি সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। মানুষের মধ্যে নিজের স্বপ্ন বপন করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের লেখা ও স্মৃতিচারণায় এক অনন্য মানবসত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, “শেখ সাহেবকে প্রথম দেখি তাঁর প্রত্যাবর্তনের দু’বছর বাদে ঢাকায় বাংলা একাডেমী আয়োজিত সম্মেলনে। ...তাঁর ভাষণ শুনে মুগ্ধ হই। ভাষণের শেষে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘জয় বাংলা’।...আমাদের ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলীর সকলের ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। বাংলা একাডেমীর ডাইরেক্টর জেনারেল সাহেবের উদ্যোগে সেটা সম্ভব হয় ১৯৭৪ সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে। দিনটা ঐতিহাসিক। সেই দিন বিকেলেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন সাতজন আরব মন্ত্রী, তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। তাঁর এক কথা। আগে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাঁরা শূন্য হাতে ফিরে যান, তবে বোঝাপড়া বোধ হয় একটা হয়েছিল। তা নইলে স্বীকৃতি না পেতেই শেখ সাহেব এত উত্ফুল্ল কেন? মুখে, চোখে বিজয়ের আনন্দ। তিনি নিজেই সেদিন আমাদের বলেন যে তাঁর জীবনের কাজ সারা হয়েছে। তিনি যা যা চেয়েছিলেন সব কিছুই পেয়েছেন। তাঁর অন্তর তখন নিস্পৃহ।...অসাধারণ তাঁর ক্যারিশমা।”
সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাধারণ কারিশমার রাষ্ট্রনায়ক। সব মোহের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দেশের মানুষের কল্যাণ চিন্তা করেছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নতুনভাবে কী করে গড়ে তোলা যায়, এই ছিল তাঁর সব সময়ের চিন্তা। তিনি মানুষের বিভেদ দূর করতে চেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ্যে মিশে সাধারণের মতোই জীবন যাপন করতে চেয়েছেন। নিজেকে কোনো ঘেরাটোপে বন্দি করতে চাননি তিনি। মানুষের সঙ্গে মিশতে চেয়েছেন। মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও তাঁর বাড়িটি ছিল সাধারণ একটি বাড়ি। বাড়ির আটপৌরে পরিবেশের সঙ্গে বাংলার সাধারণ পরিবারের অন্দরমহলের সাযুজ্য। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যদের তফাত। তিনি অসাধারণ হয়েও জীবনযাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি দেশের মানুষকে নিয়েই ভেবেছেন। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সরকারি কর্মচারী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সমাবেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘...আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।’ তিনি ওই ভাষণে আরো বলেন, ‘আমরা একটা আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছি। আমার সরকারের নীতিই হচ্ছে স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ...আপনাদের স্মরণ রাখতে হবে—সরকার একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় এবং দুর্গত মানুষের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে বদ্ধপরিকর।’ এই ভাষণে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোভাব কী হওয়া উচিত।
সবাইকে জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেন, ‘...আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশী শোষকদের পুলিশ নন, জনগণের পুলিশ। আপনাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা।’
অসাধারণ এক রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দীর্ঘদিন থেকেই বাংলা ও বাঙালির সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন, তা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট। বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে সে কথাও তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তব্যে। ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নৌবাহিনীর জোয়ানদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তিকামী জাতি। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই।’
সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা লাভকারী একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী কিভাবে চলবে তা-ও উল্লেখ করেছেন তিনি তাঁর বক্তব্যে। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে ক্যাডেটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। আর সেই শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে শৃঙ্খলা শিখতে হবে, নিজেদের সৎ হতে হবে। নিজেদের দেশকে ভালবাসতে হবে, মানুষকে ভালবাসতে হবে এবং চরিত্র ঠিক রাখতে হবে।’
দেশে তখন ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আর একদল মানুষ আছে, যারা বিদেশীদের অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায়। তারা রাতের অন্ধকারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। একটি লোক কেমন করে যে পয়সার লোভে মাতৃভূমিকে বিক্রি করতে পারে, তা ভাবলে আমি শিউরে উঠি। যারা বিদেশের আদর্শ বাংলাদেশে চালু করতে চায়, এ দেশের মাটিতে তাদের স্থান হবে না।’
নিরপরাধ মানুষকে হত্যা যে কত নির্মম সত্য, সেটা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। তাঁর কথা, তাঁর কাজ অনুসরণের ভেতর দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছিলেন দেশের মানুষের জন্য। নির্যাতন-নিপীড়ন মেনে নিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ বিরল। বাবার আদর্শের পতাকা বহন করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে নেতৃত্বে দিচ্ছেন। আমাদের ভরসা সেখানেই। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আমাদের পৌঁছে দেবে সেই বাংলাদেশে, যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সূত্র: কালের কণ্ঠ।
লেখক: সর্বইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি।