আশিকুর রহমান : আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস। দেশের পর্যটনের সবচেয়ে সুন্দর স্থান বান্দরবান। আর বান্দরবানের সবচেয়ে মনরোম স্থান হচ্ছে বাংলাদেশের ‘নায়াগ্রা ফলস’ খ্যাত আমিয়াখুম জলপ্রপাত বা খুমের-রাজ্যে (নাফাখুম, আমিয়াখুম, ভেলাখুম ও সাতভাই খুম)।
থানচি থেকে পদ্মঝিরি
এ যাত্রাটা মাত্র ১ ঘন্টার হলেও আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন দুপাশে পাহাড় ও মাঝে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীর স্বচ্ছ জলরাশি দেখে। পদ্মঝিরির মুখে নেমে ঝিরিপথ ধরে প্রায় ১ ঘণ্টা ট্র্যাকিং করলেই পৌঁছে যাবেন রুমাংজু পাড়ায়।
রুমাংজু পাড়া থেকে পাহাড় বেয়ে বেয়ে হরিশ্চন্দ্র পাড়ার দিকে যেতে হবে, এই পথটা কিছুটা ভয়ংকর ও দুর্গম। হরিশ্চন্দ্র পাড়া থেকে খেয়াং পাড়া বা নতুন পাড়া পর্যন্ত ৫-৬ টা ভয়ংকর সব পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। এক্ষেত্রে পাহাড়ে ওঠা-নামার প্রতিটি ধাপই মনে হবে একেকটি মৃত্যু কূপ।
জিনা পাড়ায় রাত যাপন।
এ পথে আসতে আসতে সাধারণতব রাত হয়ে যায়, এক্ষেত্রে জিনা পাড়া, থুইসা পাড়ায় বেশি পর্যটক অবস্থান করলেও অনেকেই আবার অতিরাম পাড়ায় অবস্থান করেন। তবে একটু কষ্ট করে জিনা পাড়ায় এগিয়ে গেলে আমিয়াখুমের পথের রাস্তাটা অনেকটাই কমে যাবে।
জিনাপাড়া থেকে আমিয়াখুম
জিনা পাড়ায় সে রাত কাটিয়ে খুব ভোরে রওনা দিতে হবে আমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে। দুই-তিন ঘন্টা ট্রেকিং করলেই দেখা মিলবে দুনিয়াতে থাকা এক বেহেস্ত আমিয়াখুম এর। ঝর্ণার বেগ আপনাকে মুগ্ধ করবে। স্বচ্ছ পানি আপনাকে নিয়ে যাবে স্বপ্নের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে।
সাত ভাইখুম, আমিয়াখুম ও ভেলাখুম দেখা শেষ হলে আবার জিনা পাড়ায় চলে আসতে হবে। এর পর দিন সকালে নাফাখুমের উদ্দেশ্যে ট্র্যাকিং শুরু করতে হবে।
সকাল ভোরে ট্র্যাকিং শুরু করলে মোটামোটি ১০ টার আগেই পৌঁছে যাবেন নাফাখুম। যেটাও দেখতে বেশ সুন্দর। চাইলে ঝর্ণার পাশেই এ পাড়ায় অবস্থান করতে পারবেন।
নাফাখুম পাড়ায় রাত্রিযাপন শেষে ভোরে নাফাখুম ঝর্ণা দেখে রেমাক্রির উদ্দেশ্যে আবার ট্র্যাকিং শুরু করতে হবে। প্রায় তিন ঘণ্টা ট্র্যাকিং শেষে রেমাক্রি এসে পৌঁছাবেন। রেমাক্রি গোসল করে আবার ট্রলারে করে থানচি চলে আসা যাবে। থানচি থেকে চান্দের গাড়িতে করে বান্দরবান সদরে।
আমিয়াখুম ঝর্ণা দেখতে কখন যাবেন?
আমিয়াখুম ঝর্ণায় সারা বছরই পানি থাকে। তবে বর্ষাকালে আমিয়াখুম ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এ সময় হড়কাবান বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের আশঙ্কা থাকে। তাই শীতকালে আমিয়াখুম যাওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। তখন পানি খুব স্বচ্ছ থাকে এবং ট্র্যাকিং করাও অনেকটা সহজ হয়। তাছাড়া শীতকালে সাঙ্গু নদীর দৃশ্যও অন্য সময়ের থেকে বেশি সুন্দর হয়।
আমিয়াখুম ঝর্ণা কিভাবে যাবেন, খরচ কত?
প্রথমে আপনাকে বান্দরবান শহরে যেতে হবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বান্দরবানের উদ্দেশ্যে কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির গাড়ি যায়। যেমন শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, সৌদিয়া, এস আলম, ডলফিন। এর যেকোনো একটি বাসে আপনি বান্দরবানের যেতে পারেন। রাত ৯-১০ টা অথবা সাড়ে ১১টার দিকে আব্দুল্লাহপুর, গাবতলি, কল্যাণপুর, কলাবাগান, সায়দাবাদ বা ফকিরাপুল থেকে এসব বাস বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নন এসি বাসে জন প্রতি ভাড়া ৯০০ টাকা। এসি ১৪০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যেতে পারেন। বদ্দারহাট থেকে বান্দারবানের উদ্দেশে পূবালী ও পূর্বানী পরিবহনের বাস যায়। এসব বাসে জনপ্রতি ৪২০টাকা ভাড়া রাখা হয়।
এবার বান্দরবান শহর থেকে চাঁন্দেরগাড়ি বা লোকাল বাসে করে থানচি যেতে হবে। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত লোকাল বাস জন প্রতি ২২০ টাকা এবং চাঁন্দেরগাড়ি ভাড়া ৭৫০০ টাকা। থানচি নেমে টুরিস্ট তথ্য কেন্দ্রে এন্ট্রি করতে হবে। এন্ট্রির কাগজ এবং গাইড নিয়ে থানচি থানায় গিয়ে অনুমতি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রলার ঘাটে পৌঁছে যেতে হবে। কারণ বিকাল ৫ টার পর আর্মিরা পদ্মঝিরি বা রেমাক্রি যাওয়ার অনুমতি দেয় না।
সম্পূর্ণ ট্যুরের জন্য গাইড ভাড়া ৫০০০ টাকা এবং গাইডের খাওয়া থাকা আপনাকেই বহন করতে হবে। তবে আগে থেকে গাইড ঠিক করে গেলে ভালো। থানচি ট্রলারঘাট থেকে দুইভাবে আমিয়াখুম যাওয়া যায়। ট্রলারে করে প্রথমে পদ্মঝিরির মুখ যেতে হবে। ট্রলার ভাড়া যাওয়া-আসা ৫০০০ টাকা, এক ট্রলারে সর্বোচ্চ ৫ জন করে যাওয়া যায়। ট্রলার থেকে নেমে পুরোটাই ট্র্যাকিং করতে হবে, প্রায় ৮-১০ ঘণ্টা ট্র্যাকিং করলেই পৌঁছে যাবেন আমিয়াখুম ঝর্ণায়। এই পথটি একটু কঠিন এবং পাহাড়ে ওঠা-নামা করতে হয় বেশি।
ট্রলারে করে রেমাক্রি বাজার, ট্রলাম ভাড়া যাওয়া-আসা ৬০০০ টাকা। ট্রলার থেকে নেমে ১০-১২ ঘণ্টা ট্র্যাকিং করলেই আমিয়াখুম পৌঁছে যাবেন। এই পথে ট্রেকিং করা একটু সহজ, কিন্তু সময় ৩-৪ ঘণ্টা বেশি লাগবে।
আমিয়াখুম ঝর্ণায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
রেমাক্রি বাজার, নাফাখুম পাড়া, জিন্না পাড়া এবং থুইসা পাড়ার পাহাড়িদের সঙ্গে থাকা-খাওয়া সুব্যবস্থা আছে। থাকা জনপ্রতি ১৫০ টাকা এবং জন প্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা মধ্যে বিভিন্ন প্যাকেজে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
আমিয়াখুম ঝর্ণা ভ্রমণে সঙ্গে যা নিতে হবে
এনআইডি, পাসপোর্ট, স্টুডেন্ট আইডি কার্ডের ফটোকপি (৫ কপি বাধ্যতামূলক) নিতে হবে। অবশ্যই ভালো মানের ট্র্যাকিং ব্যাগ নিতে হবে। যেটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ট্রেকিং করলেও পিঠ ঘামবে না আর কোমড়ের উপরে চাপ সৃষ্টি করবে না। বর্ষাকালে গেলে সঙ্গে অবশ্যই রেইন কোর্ট ও বড় পলিথিন নেবেন। এড়াও ট্র্যাকিং প্যান্ট, ট্র্যাকিং স্যান্ডেল, শুকনা খাবার, হ্যান্ড গ্লাভস, হেড ল্যাম্প, টি শার্ট ২/৩ টি, হাফ প্যান্ট, ট্রাউজার, ট্র্যাকিং পোল, মোজা ১/২ জোড়া, টুথ ব্রাশ, পেস্ট, সাবান, গামছা, পানির বোতল, প্রাথমিক ওষুধ, স্যালাইন, গ্লুকোজ, মশার জন্য ওডোমস ক্রিম ও পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে নেবেন।
ভ্রমণের প্রয়োজনীয় কিছু টিপস
অনুমতি ছাড়া স্থানীয়দের ছবি তুলবেন না। যেখানে সেখানে শুকনো খাবারের খোসা, প্লাস্টিক জার বা বোতল ফেলবেন না। আপনাকে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা ট্র্যাকিং করতে হবে। তাই যতটা সম্ভব হালকা ব্যাগ প্যাক রাখার চেষ্টা করবেন। অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু না নেওয়াই বুদ্ধিমানে কাজ।
নিউজনাউ/এবি/২০২২